ডাক্তাররা কেন গ্রামে যায় না
বাংলাদেশের সরকারি ডাক্তারদের নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে তারা গ্রামে যেতে চায় না। দেশের মানুষের টাকায় পড়াশোনা করে যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই গ্রামের দরিদ্র অসহায় মানুষের চিকিৎসায় তারা কোন কাজে আসে না। শুধু তাই না, যদিওবা ঠেলায় পড়ে যায় (যেমন কয়দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়ে গিয়েছিল), বেশিদিন থাকে না। প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে ঢাকায় বা কাছের কোন শহরে পোস্টিং নেয়।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কারণটা কী? মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার আগে বা পরে কিংবা ডাক্তার হওয়ার আগে প্রশ্ন করলে তারা ব্যতিক্রমহীনভাবে বলে, দুস্থ মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করব, গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেব। কিন্ত হায়, কর্মজীবনে প্রবেশ করে আর কেউ কথা রাখে না। অল্প সময়ে প্রচূর বিত্ত অর্জনের যে মরনব্যধি বাংলাদেশকে গ্রাস করেছে, তাতে সামিল হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে চলে। বড় বড় নীতি কথা পথের পাশে পড়ে থাকে। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নাই তা নয়, তবে তা ব্যতিক্রমই।
এছাড়া রয়েছে অন্যান্য সমস্যা। যেমন, উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও সহযোগী/সহকারী কর্মীর অভাব, বাসস্থান ও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, বিনোদেনের অভাব, স্থানীয় প্রশাসনের হম্বিতম্বি ও অনৈতিক আবদার, পেশাগত পরিকল্পনার অভাব, উচ্চশিক্ষার সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি।এত অসুবিধার মধ্যে ডাক্তাররা গ্রামে যাবে কেন, আর চাকরি রক্ষার জন্য গেলেই বা থাকবে কেন?
তাহলে কি করতে হবে? একেবারে প্রথম থেকে ডাক্তার বানানোর পদ্ধতিটাকে ঠিক করতে হবে। প্রথমেই নজর দিতে হবে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার দিকে। সাধারণ ডাক্তার (general practitioner বা family physician)হবার জন্য খুব বেশি মেধার প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন হচ্ছে দেশ ও মানব প্রেম, গ্রামদেশে কাজ করার মানসিকতা, সাধারণ মানুষের সেবা করার প্রণোদনা ইত্যাদি। মোট ভর্তি হওয়া ছাত্রদের মধ্যে ৩৩%-এর মত বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়াশুনা করে, গবেষণা করার জন্য তাদের মেধাবী হওয়ার প্রয়োজন আছে। কাজেই ভর্তি ব্যবস্থা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে এই দুই ধরনের চাহিদাই মেটান যায়।বিসিএস-এর জন্য ক্ষতিকারক হলেও মেডিক্যালের জন্য দরকার কোটা ব্যবস্থা। এখানে ১/৩ অংশ আসন মেধার ভিত্তিতে পুরণ হবে, আর বাকি ২/৩ অংশ পুরণ হবে জেলাভিত্তিক মেধার ভিত্তিতে।মেধা ভিত্তিতে উত্তীর্ণদের তাদের পছন্দ অনুযায়ী আসন বন্টন করতে হবে। অন্যদিকে, জেলাকোটায় উত্তীর্ণদের আসন দেয়ার সময়ে খেয়াল রাখতে হবে যেন যার যেটা স্থায়ী ঠিকানা, তাকে তার নিকটস্থ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। এখানে ছাত্রদের কোন পছন্দ থাকবে না। জেলা কোটার সুবিধা পাওয়ার বিপরীতে ছাত্রদের বন্ড দিতে হবে যে, পাশ করার পর কম পক্ষে দুই বছর ঐ জেলা বা বিভাগে সে কাজ করবে। তারপরই কেবল উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে কিংবা কর্মস্থল পরিবর্তনের জন্য আবেদন করতে পারবে। আরো পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থাকে উন্নত করা যায়।
এরপর নজর দিতে হবে পাঠক্রমের দিকে। বর্তমানের পশ্চিমমুখি পাঠক্রমকে বাংলাদেশের উপযুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে। জোর দিতে হবে, দেশের রোগব্যাধির চিকিৎসার উপর, বিশেষ করে স্বল্প সম্পদের প্রেক্ষাপটে কি করে তা মোকাবিলা করা যায়। শুধু নিরাময় নয়, রোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে পড়াতে হবে, জনস্বাস্থ্যের ব্যবহারিক tools-গুলি শিখিয়ে দিতে হবে। সমাজ মেডিক্যাল সমাজবিদ্যা এবং স্বাস্থ্যঅর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো পড়াতে হবে তাকে দেশের এবং সমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। এগুলো একজন ভবিষ্যৎ ডাক্তারকে রোগীর প্রতি সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করবে। ব্যবহারিক বিদ্যা এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে ছাত্রঅবস্থা থেকেই তারা দেশের স্বাস্থ্যসমস্যা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারে, হাতে কলমে গ্রামদেশে রোগ নিরাময়ের কাজের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। এছাড়া, পাঠক্রমে একজন ভাল ডাক্তার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আচরণগত গুণাবলি অর্জনের ব্যবস্থ্যা থাকতে হবে।
এছাড়া, দূরবর্তি এলাকায় কাজ করার জন্য বিশেষ ভাতা, কাজ অনুযায়ী পুরস্কার বা তিরস্কার এবং নিয়মিত বিরতিতে সেইসব এলাকা থেকে বদলি ইত্যাদি ডাক্তারদের গ্রামবাসকে সহনীয় করে তুলবে। সবশেষে, ডাক্তারদের জন্য দরকার একটা স্বচ্ছ, ন্যায়ানুগ, এবং দলাদলিমুক্ত পেশাগত পরিকল্পনা যেন প্রত্যেকেই তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পড়াশুনা ও পদোন্নতির সুযোগ পায়। গ্রামে পড়ে থাকার জন্য সে যেন বঞ্ছিত না হয়। আর এসব কিছু ঢেলে সাজানোর জন্য দরকার রাজনৈ্তিক অঙ্গীকার আর দূরদর্শিতা, জোরজবরদস্তি নয়।
No comments:
Post a Comment