কেমন ডাক্তার চাই
আজকাল খবরের পাতা খুললেই দেখা যায় ডাক্তারদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ-ডাক্তারদের ব্যবসায়ী মনোভাব, রোগীদের সাথে অসদাচরণ, কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি, অনৈতিকতা ইত্যাদি। ধনী, গরিব-সমাজের সর্বস্তরের কাছ থেকে আসে এই অভি্যোগ। সরকারী বা বেসরকারী অত্যাধুনিক হাসপাতাল কেউই এই অভি্যোগের বাইরে নয়। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবকালেই ছিল-তবে ইদানিং তার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।এবং অধিকাংশ অভিযোগেরই বাস্তব ভিত্তি আছে। যদিও সব অভিযোগের জন্য ডাক্তাররাই একক ভাবে দায়ী নন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এজন্য দায়ী আমাদের অকার্য্যকর, অসংবেদনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ত্রুটিপুর্ন স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যবস্থা ।
আসলে আমাদের দেশের মানুষ বা রোগীরা কেমন ডাক্তার চান? ডাক্তারদের মাঝে তারা কি কি গুনাবলী আশা করেন? ডাক্তারদের কিরকম আচারণ তাদের পছন্দ, যা তাদের সন্তুষ্ট করতে পারে? তারা কি ভাল ডাক্তার বলতে শুধু একজন পেশাগতভাবে দক্ষ ডাক্তারকে বোঝান না কি সেই সাথে একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষকেও দেখতে চান? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রোগী বা তার স্বজনদের অভিযোগগুলো একটু বিশ্লেষণ করে দেখলে কাঙ্ক্ষিত ডাক্তারের স্বরুপটি বোঝা যেতে পারে। এটা জানা খুবই জরুরি শুধু এজন্য নয় যে তা অভিযোগগুলোর সুরাহা করতে সাহায্য করবে, এটা রোগীর দ্রুত আরোগ্যের জন্যও দরকার কেননা ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক রোগীর মানসিক অবস্থাকেও প্রভাবিত করে, আর সেই সঙ্গে প্রভাবিত করে ডাক্তারের নির্দ্দেশ অনুযায়ী অষুধ এবং পথ্য গ্রহণকে।
আমাদের দেশে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক এবং রোগীর চিকিৎসার উপর তার প্রভাব বিষয়ে বলতে গেলে কোন কাজই হয়নি।বিদেশে এ বিষয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে এবং এখনও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে। এসব গবেষণা থেকে রোগীদের দৃষ্টিতে একজন কাঙ্ক্ষিত ডাক্তারের মধ্যে কি কি গুণাবলী থাকলে সে সন্তুষ্ট হতে পারে সে বিষয়ে জানা গেছে। এরকম কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরব যা পাঠকরা এবিষয়ে নিজেদের ধারণার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মেয়ো ক্লিনিকে ২০০১ এবং ২০০২ সালে ছয়মাস ব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, রোগীরা যে সব ডাক্তারদের পছন্দ করে তাদের মধ্যে প্রধানত সাত ধরনের বৈশিষ্ট বিদ্যমানঃ নিজের রোগ নিরাময়ের ক্ষমতায় আত্মবিশ্বাস যা কিনা রোগীর আস্থা তৈরী করে, রোগীর প্রতি সহমর্মিতা, মানবিক আচরণ, রোগীর প্রতি নিবিঢ় মনোযোগ, স্পস্টবাদিতা, বিনয় এবং রাখ-ঢাক না করে সোজাসুজি রোগ আর তার চিকিতসা সম্বন্ধে খুলে বলা। তাদের মতে ভাল ডাক্তার তারাই যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্টগুলির কোন একটি বা একাধিকটি দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক একই ভাবে একজন খারাপ ডাক্তার-এর মধ্যে এর বিপরীত আচরণগুলি যেমন আত্মবিশ্বাসের অভাব, রুঢ় ব্যবহার, সহমর্মিতার অভাব, রোগীর প্রতি মনোযোগের অভাব ইত্যাদি বর্তমান।
আর এক গবেষণায় রোগীরা বলেছে যে, তারা চায় ডাক্তার তাদের জ়ানাক তাদের রোগটা কি, কি চিকিতসা দেয়া হবে এবং তা কি ভাবে তাদের রোগ নিরাময় করবে। সাধারনত: রোগীরা একটা অজানা আশঙ্কা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। তারা চায়, ডাক্তার সোজাসুজি তাদের দিকে চোখ রেখে কথা বলুক, অন্যাদিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে নয়। তারা তাদের ভাল করে, সময় নিয়ে, পরীক্ষা করে দেখুক।এমন ভাষায় কথা বলুক যা তারা বুঝতে পারে।
ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল-এর জন্য হারিস পোল এর ২,২৬৭ জন পুর্ণবয়স্ক মানুষের উপর করা আর এক সমীক্ষায় রোগীদের সন্তুষ্টির জন্য ডাক্তারদের আচরণগত বৈশিষ্টের উপরই বেশী জোর দেয়া হয়েছে। যেমন, রোগীদের প্রতি সম্মান দেখান (৮৫%), মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনা (৮৪%), পরিক্ষা নিরীক্ষায় যথেষ্ট সময় দেয়া (৮১%) ইত্যাদি। এছাড়া দেখা গেছে, ডাক্তাররা যখন সহানভুতির সাথে রোগীকে দেখেন, রোগীরা তখন তাদের উপদেশ ঠিক ভাবে মেনে চলেন, পথ্য ঠিকমত খান, এবং রোগ নিরাময় দ্রুত হয়।রোগির আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনই হচ্ছে চিকিতসার প্রথম ধাপ। এটা হলে পরে অষুধ ও পথ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও ডাক্তারের নির্দেশাবলী ঠিকমত মানা্র সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে এর কোনটাই ডাক্তারের রোগ নিরাময়ের দক্ষতার (technical skill)সাথে সম্পৃক্ত নয়। বরং তা হচ্ছে মানবিক, সংবেদনশীল মনের প্রকাশ। অন্যান্য সেবার সাথে চিকিৎসা সেবার পার্থক্য হচ্ছে এখানে সেবা গ্রহনকারী (রোগী) এবং সেবা প্রদানকারীর মধ্যে জানার পার্থক্য (information asymmetry) অনেক। রোগব্যাধি ও তার চিকিতসা সম্পর্কে কম জানার জন্য তাকে এ বিষয়ে ডাক্তারের উপরই বিশ্বাস রাখতে হয়। সে তখন বরং ডাক্তারের আচরণের প্রতিই বেশী জোর দেয়, খুটিয়ে খুটিয়ে তা লক্ষ্য করে। একজন রোগী যখন অসুখ, ব্যথা, ভয় এবং অজানা উদ্বেগ নিয়ে আসে, ডাক্তারের সামনে তখন তা একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আর তা হচ্ছে ওই অবস্থায় দ্রুত রোগীর আস্থা অর্জন করে চিকিতসা শুরু করা, চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে সম্পৃক্ত করা । মনে রাখতে হবে, ডাক্তারদের শুধু রোগ নিরাময় (cure) করলেই হবেনা, রোগীদের যত্নও (care)নিতে হবে। একজন নবীন ডাক্তারকে রোগীর প্রতি এই সংবেদনশীলতা তার শিক্ষানবীশ কালেই রপত করতে হয়।দূঃখজনক ভাবে আমাদের চিকিতসা শিক্ষা ব্যবস্থায় এ প্রশিক্ষনের অভাব রয়েছে।যার জন্য চিকিৎসাবিদ্যায় ঘাটতি না থাকলেও যথাযথ আচরণের অভাবে আমাদের ডাক্তাররা রোগীর সন্তুষ্টি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।কথায় আছে, ডাক্তারের ব্যবহারই অর্ধেক রোগ ভাল করে দেয়, বাকিটা করে অষুধ।
আমাদের দেশে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এ বিষয়ে চিকিতসা শিক্ষাব্যবস্থার নজর দেয়ার সময় হয়েছে। তা না হলে পরিস্থিতির শুধু অবনতিই হবে।
1 comment:
It would be nice to know the sources of your information. Would you please cite your sources when you use them in a post? Thank you.
Post a Comment